আম-আঁটির ভেঁপু গল্পের অনুরূপ গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি আছে এ রকম আমার পঠিত, আরেকটি রচনা হলো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি। সেখানে কেতুপুর গ্রাম ও জেলেপাড়ার যে অসাধারণ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা বাংলা সাহিত্যে সত্যিই বিরল।"পদ্মানদীর মাঝি"তে গ্রামীণ অভাব-অনটন এবং তাকে পুঁজি করে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা এই বিষয়গুলো খুব শৈল্পিকভাবে ফুটে উঠেছে। গরিব মানুষদের মুখ দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিখ্যাত বাক্যটিও বলিয়ে নেন। যথা-ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে তাহাকে এখানে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।গ্রামীণ জীবনের প্রেম-প্রীতির বিষয়টিও উপন্যাসটিতে সাদৃশ্যমান। কপিলা ও কুবেরের প্রেম বর্ণনা, স্ত্রী মালার প্রতি কুবেরের অনীহা, মহাজন শীতল বাবুর ওপর গণেশ ও কুবেরের রাগ-ক্ষোভ- এ বিষয়গুলো গ্রামীণ সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক। সন্তান জন্মগ্রহণ করলেও কুবের খুব বেশি সুখী হতে পারে না, কারণ তার অভাব। হোসেন মিয়া নামক খলনায়ক চরিত্রটি গ্রামের মানুষদের নিয়ে যেতে চায় তার গঠিত চর এলাকা ময়না-দ্বীপে। গণেশ ও কুবেরের দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার মধ্যেও আমরা গ্রামবাংলার আবহমান কালের যে আন্তরিক পরিচয় পাই তা সত্যিই অভিনব। কেতুপুর গ্রামের প্রকৃতি ও পরিবেশের যে নিবিড় বহমানতার বর্ণনা উপন্যাসটিতে আছে তা খুবই বাস্তবসম্মত। গোপীর সঙ্গে লখার খেলাধুলার বর্ণনাতে আমরা 'পথের পাঁচালীর' অপু-দুর্গার সাদৃশ্য কল্পনা করতে পারি। আবার 'পদ্মানদীর মাঝি'তে গ্রাম্যমেলার যে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তার মাধ্যমে আমরা আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যের একটি পরিপূর্ণ পরিচয় লাভ করতে সমর্থ হই। তাই আমি মনে করি, শাশ্বত-নৈসর্গিক অপরূপ প্রকৃতি এবং আমাদের দেশের গ্রামীণ সমাজের অনেক অজানা তথ্য জানার জন্য আমাদের সবারই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসটি পাঠ করা দরকার।